ইলেকট্রনের চার্জ নির্ণয়ঃ বিখ্যাত তৈলবিন্দু পরীক্ষা!
- নাফিউর রহমান পিয়াল
- Aug 17, 2018
- 5 min read
ছোটবেলায় কেমিস্ট্রি বইয়ে পড়া একটা লাইনের কথা খুব মনে পড়ে, "ইলেকট্রনের চার্জ নির্ণয়ঃ রবার্ট মিলিকন তাঁর বিখ্যাত তৈলবিন্দু পরীক্ষার সাহায্যে ইলেকট্রনের চার্জ নির্ণয় করেন"—ব্যস! শেষ!! বইয়ের কথা এইটুকুতেই শেষ! আর কিছু নাই! সেই “বিখ্যাত তৈলবিন্দু পরীক্ষাটা”টাই বা কী, আর সেটা দিয়ে মিলিকন নামের ভদ্রলোক ইলেকট্রনের চার্জই বা কীভাবে নির্ণয় করলেন—নাই!! বইয়ে এই নিয়ে আর একটা টু শব্দও করা নাই!!
আমাদের স্কুল কলেজের পাঠ্য বইগুলা এমনই। মজায় মজায় জানানো, শেখানো তো দূরে থাক—অনেক সময় একটা টপিক পুরোপুরি বুঝতে যতটুকু আলোচনা থাকা দরকার বইয়ে সেটাও থাকেনা! থাকে শুধু এরকম আধা আধা লাইন, "ইলেকট্রনের চার্জ নির্ণয়ঃ রবার্ট মিলিকন তাঁর বিখ্যাত তৈলবিন্দু পরীক্ষার সাহায্যে…… "
তো সে যাই হোক। পাঠ্য বই নিয়ে আলোচনা করে লাভ নাই। তারচেয়ে বরং কাজের কথায় আসি। ববার্ট মিলিকনের বিখ্যাত তৈলবিন্দু পরীক্ষা। কেউ যদি ইন্টারনেট ঘেঁটে বা বাইরের কোনো বইপত্র ঘেঁটে তৈলবিন্দু পরীক্ষা সম্পর্কে জেনে থাকে তাহলে তো বেশ ভালো। তবে আমি মোটামুটি নিশ্চিত স্কুল কলেজ পার হওয়া অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রীরাই আর পরে এটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে নাই। আমি কিঞ্চিত ঘাঁটাঘাটি করেছিলাম। সেই ঘাঁটাঘাঁটি থেকে যতটুকু যা জেনেছি বুঝেছি তাই নিয়েই এই লেখা……
তো শুরু করা যাক। আমাদের যেকোনো ফিজিক্স বইয়েই তড়িৎ নিয়ে আলোচনা করা হোক না কেন, সাধারণত সব বইয়েই শুরুতেই একটা উদাহরণ থাকে, সেটা হলো চিরুনি আর ছোট ছোট কাগজের টুকরা সংক্রান্ত। চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ানোর পর সেটাকে যদি খুব ছোট ছোট কাগজের টুকরার কাছে ধরা হয়, তাহলে দেখা যায় যে কাগজের ছোট টুকরাগুলো লাফ দিয়ে এসে চিরুনিতে লেগে যাচ্ছে। তখন বলা হয় যে ঘর্ষণের ফলে চিরুনি চার্জগ্রস্ত হচ্ছে তাই এমনটা ঘটছে। এটা স্থির তড়িতের একটা মজার উদাহরণ যেখানে ঘর্ষণের কারণে চিরুনি চার্জগ্রস্ত হচ্ছে। অর্থাৎ কোনো বস্তুকে ঘষলে সেটা চার্জগ্রস্ত হতে পারে। এমন আরও অনেক উদাহরণ বইয়েই পাওয়া যায়; যেমন পশম আর কাচ দণ্ডের ঘর্ষণ, রেশম আর ইবোনাইট দণ্ডের ঘর্ষণ ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি…..
কাহিনীটা এইখানেই। রবার্ট মিলিকন নামের সেই ভদ্রলোক ভাবলেন, শুধু কঠিন পদার্থের সাথে কঠিন পদার্থের ঘর্ষণেই কি বস্তু চার্জগ্রস্ত হয়? ঘর্ষণে কি তরলের ক্ষেত্রেও এটা হতে পারেনা? ব্যস!! এই চিন্তাতেই এলো সেই বিখ্যাত তৈলবিন্দু পরীক্ষা! তখন তিনি যেটা করলেন তা হলো, একটা অ্যাটোমাইজারে তেল ভরলেন, যাতে তেল স্প্রে করা যায় (অ্যাটোমাইজার কী যারা জানেন না, তাদের উদ্দেশ্যে বলে রাখি-- অ্যাটোমাইজার হচ্ছে সেই জিনিসটা যেটা দিয়ে কোনোকিছু স্প্রে করা যায়। চেনার জন্য সবচেয়ে সহজ উদাহরণ হতে পারে চুল কাটার সেলুন। অনেক সেলুনেই চুল কাটার সময় মাথায় পানি স্প্রে করা হয়। যে জিনিসটা দিয়ে এই কাজটা করা হয় সেটাই অ্যাটোমাইজার)।

এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো যে, অ্যাটোমাইজারের ভেতরে যে তরলই থাকুক না কেন, সেটা যখন স্প্রে করা হয়, অ্যাটোমাইজারের মুখ থেকে বের হওয়ার সময় সেটা অবশ্যই অ্যাটোমাইজারের মুখের সাথে একটা বেশ ভালো রকমের ঘর্ষণে লিপ্ত হয়। মিস্টার মিলিকনের উদ্দেশ্য ছিলো এটাই দেখা যে, স্প্রে করার পরে ঘর্ষণ খেয়ে বের হয়ে আসা এই তেলের ফোঁটাগুলো চার্জগ্রস্ত হয় কি হয় না। এটা দেখার জন্য তিনি বেশ ভালো রকমের আয়োজন করে সবকিছু সাজালেন। তিনি যেটা করলেন তা হলো, একটা স্বচ্ছ আবদ্ধ পাত্র নিলেন (যেটার একপাশে ছোট্ট একটা ঢাকনা আছে, যেটা চট করেই খোলা বা বন্ধ করা যায়), যাতে এই বন্ধ পাত্রের ভেতরে কী ঘটে সেটা তিনি বাইরে থেকে দেখতে পারেন। আর হ্যাঁ, ভালো কথা, এই পাত্রের ভেতরে তিনি আগে থেকেই দুইপাশে ধারকের দুইটা প্লেট সেট করে রেখেছিলেন। তো যাই হোক, এবার তিনি সেই ছোট্ট ঢাকনাটি খুলে পাত্রের মধ্যে অ্যাটোমাইজার দিয়ে তেলের ফোঁটা স্প্রে করে দিয়ে ঢাকনাটি বন্ধ করে দিলেন! তেলের ফোঁটাগুলো যেন একদম স্পষ্ট দেখা যায় তাই তিনি একটা উপযুক্ত অণুবীক্ষণ যন্ত্র সেট করে সেই ব্যবস্থাও করে নিলেন! এবার শুরু আসল খেলা! তিনি খেয়াল করলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি ধারকের সেই দুই প্লেটের সাহায্যে কোনো তড়িৎক্ষেত্র প্রয়োগ না করছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তেলের ফোঁটাগুলো অভিকর্ষ বলের জন্য একটা ত্বরণে নিচের দিকে পড়ছে। কিন্তু যেহেতু তেলের ফোঁটাগুলো খুবই ছোট, তাই কিছুক্ষণ পরেই ফোঁটাগুলিকে বাধা দেওয়া বাতাসের ঘর্ষণ বল (ঊর্ধ্বমুখী) আর অভিকর্ষ বল (নিম্নমুখী) সমান হয়ে যায় এবং লব্ধিবল শূণ্য হয়ে যাওয়ার কারণে ফোঁটাগুলো একটা সমবেগে নিচে পড়তে থাকে।
এইবার তিনি করলেন আসল কাজ! ধারকের প্লেট দুইটার মধ্যে তিনি Voltage Difference- অর্থাৎ বিভব পার্থক্য সৃষ্টি করলেন। দেখা গেলো যে, এতে তেলের ফোঁটাগুলোর বেগে পরিবর্তন এসেছে!! তার মানে ঘর্ষণের ফলে তেলের ফোঁটাগুলো সত্যিই চার্জগ্রস্ত হয়েছিলো! তিনি একবার এই প্লেটে উচ্চ বিভব ঐ প্লেটে নিম্ন বিভব, আরেকবার ঐ প্লেটে উচ্চ বিভব এই প্লেটে নিম্ন বিভব—এভাবে বিভিন্নভাবে বিভব পার্থক্য প্রয়োগ করছিলেন; আর বিভব পার্থক্যের এই অভিমুখের উপর নির্ভর করে তেলের ফোঁটাগুলোর বেগ হয় বাড়ছিলো না হয় কমছিলো। এসব দেখেশুনে সবশেষে মিলিকন বেছে নিলেন বিভব পার্থক্যের সেই অভিমুখটা- যেটা তেলের ফোঁটাগুলোর বেগকে কমিয়ে দিচ্ছিলো- অর্থাৎ মন্দন সৃষ্টি করছিলো। এবার তিনি একটু একটু করে বিভব পার্থক্যের মান বাড়াতে থাকলেন, আর তেলের ফোঁটাগুলোর বেগ আরও কমতে থাকলো। এমনি করে তেলের ফোঁটার বেগ কমতে কমতে একসময় সেটা থেমে গেলো! বেশ কয়েকঘণ্টা ধরে তিনি একটিমাত্র তেলের ফোঁটার গতিকে খুব ভালোভাবে খেয়াল করলেন এবং ইচ্ছামতো বিভব পার্থক্যের দিক পরিবর্তন করে করে তিনি সেটার গতিকে ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করলেন বা থামিয়ে দিলেন!
এবার একটু হিসাবে আসা যাক। বিভব পার্থক্য প্রয়োগের আগ পর্যন্ত যা যা ঘটেছিলো, প্রথমে আমরা সেগুলোর একটা হিসাব নিকাশ করি। নিম্নমুখী অভিকর্ষ বল আর ঊর্ধমুখী বাতাসের বাধাজনিত বলের সমতাকে আমরা এভাবে সমীকরণ আকারে লিখতে পারি-
mg = av ----------------------(1)
যেখানে,
m = তেলের ফোঁটার ভর;
g = অভিকর্ষজ ত্বরণ = 9.8 ms-2;
a = বাতাসের বাধা গুণাঙ্ক;
v = লব্ধি বল শূণ্য হওয়ার সময় তেলের ফোঁটার প্রাপ্ত সমবেগ;
তেলের ঘনত্ব তো জানাই ছিলো। তেলের ফোঁটার ব্যাস মাপা হলো অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে। সেখান থেকে পাওয়া গেলো ব্যাসার্ধ এবং খুব সহজেই তেলের ফোঁটার আয়তন (4πr3/3)। এই আয়তনের সাথে তেলের ঘনত্ব গুণ করে পাওয়া গেলো তেলের ফোঁটার ভর (m) (ভর = ঘনত্ব X আয়তন)।
তেলের ফোঁটা যখন সমবেগে নিচের দিকে পড়ছলো, মিলিকন তখন অণুবীক্ষণ যন্ত্রের লেন্সে খোদাই করা স্কেলের সাহায্যে এবং একটি স্টপওয়াচ ব্যবহার করে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে ফোঁটাটির নিচের দিকে পড়ার সমবেগ (v) নির্ণয় করে ফেললেন। m, g, v জানা হয়ে গেলো। এবার তিনি (1) নাম্বার সমীকরণ ব্যবহার করে সহজেই বাতাসের বাধা গুণাঙ্ক a এর মান বের করে ফেললেন।
এবার হিসাব করা যাক বিভব পার্থক্য প্রয়োগের পর যা যা ঘটলো সেটা। মিলিকন সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থাটা বেছে নিলেন হিসাবের জন্য। তিনি এমন একটা বিভব পার্থক্য বেছে নিলেন, যে বিভব পার্থক্যের জন্য তেলের ফোঁটাগুলো সমবেগে উপরের দিকে উঠছিলো। অর্থাৎ বিভব পার্থক্য প্রয়োগ করার ফলে যে তড়িৎ বল সৃষ্টি হয় সেটা (F=qE) আর অভিকর্ষ বল (mg)— এই দুই বলের লব্ধি প্রভাবে তেলের ফোঁটাগুলো সমবেগে উপরের দিকে উঠছিলো। এইক্ষেত্রে সমবেগের মান v' হলে---
qE – mg = av' ------------------(2) [যেহেতু এক্ষেত্রে তেলের ফোঁটাগুলো সমবেগে উপরে ওঠে, কাজেই qE > mg এবং a হলো বাতাসের বাধা গুণাঙ্ক]
আগের মতোই একইভাবে অণুবীক্ষণ যন্ত্র আর স্টপওয়াচ দিয়ে v' এর মান বের করা যায়। আর কত মানের তড়িৎক্ষেত্র (E) প্রয়োগ করায় ঘটনাটি ঘটেছিলো মিলিকন সেটা দেখে নিলেন। আর m, g আর a এর মান তো আগে থেকেই জানা! কাজেই E, m, g, a এবং v' এর মান জানা থাকায় (2) নাম্বার সমীকরণের সাহায্যে সহজেই মিলিকন অজানা q এর মান বের করে ফেললেন!
কমবেশি স্প্রে করে করে তিনি কয়েকবার এই পুরো পরীক্ষাটা করলেন। স্প্রে করা তো আর সব বারই একরকম হয় না, তাই একেকবার তেলের ফোঁটা একেকভাবে চার্জিত হচ্ছিলো- কোনোবার কম কোনোবার বেশি। তাই q এর বিভিন্ন রকম মান পাওয়া যাচ্ছিলো। কিন্তু মানগুলো ছিলো 3.2 X 10-19 C, 4.8 X 10-19 C, 1.6 X 10-19 C এমন, অর্থাৎ সবাই 1.6 X 10-19 C এর সরল গুণিতক! কোনো বস্তু যখন চার্জিত হয়, তখন সেই বস্তুতে “কিছু” ইলেকট্রন যুক্ত হয় (Negatively Charged) বা “কিছু” ইলেকট্রন সেই বস্তুকে ছেড়ে চলে যায় (Positively Charged) এবং এই “কিছু” অবশ্যই একটি পূর্ণ সংখ্যা! কাজেই মিলিকন সহজেই বুঝে গেলেন যে একটি ইলেকট্রন এর চার্জের মান অবশ্যই 1.6 X 10-19 C!
খুব সহজ! তাইনা??
Comments